রামু সংবাদদাতা :: কক্সবাজারের রামু উপজেলায় বনবিভাগের হাজার হাজার একর জমিতে দেদারছে তামাক চাষ অব্যাহত রয়েছে, সরকারী জমিতে তামাক চাষ নিষিদ্ধ হলেও বনাঞ্চলের অভ্যন্তরে সংশ্লিষ্ট বনবিভাগের রহস্যজনক নীরবতায় পাহাড় ও টিলা ভুমিতে প্রতি মৌসুমে তামাক চাষের ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশংকা দেখা দিয়েছে,যুগ যুগ ধরে দেশের উত্তর বঙ্গে এসব তামাক চাষ হয়ে আসলেও কক্সবাজার জেলার রামু ও পার্শ্ববর্তী নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় মুলত ৯০ এর দশক থেকে বৃটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো,নেভী (পরিবর্তিত) জে,এল,টি ট্যোবাকো আবুল খায়ের টোব্যাকো সহ অন্যান্য কোম্পানীর অধীনে তামাক চাষ শুরু হয়,শুরু থেকেই তামাক কোম্পানী গুলো কর্তৃক চাষীদের লোভনীয় অপার ছিলো স্বল্প সুদে ঋন প্রদান, পরিবেশের হুমকী না হওয়ার মতো নিজস্ব মালিকানাধীন জমিতে চাষাবাদের কথা বলা হলেও সময়ের পরিক্রমায় চাষীরা একত্রিত ভাবে মুনাফা পাওয়ার প্রলোভনে আসক্ত হয়ে এতদাঞ্চলের হাজার হাজার কৃষক এই চাষাবাদের প্রতি ঝুঁকে পড়ে।
দীর্ঘ সময় ধরে তামাক চাষের ফলে মাটির উর্বর শক্তি যেমন কমে যাচ্ছে অপরদিকে পাতা, শিরা, উপশিরায় বিষাক্ত নিকোটিন নিয়ে বেড়ে উঠা তামাক নামক এ উদ্ভিদ পরিবেশে দূর্গন্ধ ছড়িয়ে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এদিকে মানুষের জীবন ধারনের অপরিহার্য্য খাদ্য শস্যের উৎপাদনের মাত্রা দিন দিন কমে গেলেও ঠিক তেমনিভাবে তামাক চাষের প্রবনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখানকার শত শত একর জমিতে তামাকের বিষ ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশের মারাত্বক ক্ষতি হচ্ছে।
তথ্যানুসন্ধানে সাধারনত কৃষকরা টোব্যাকো কোম্পানির লোভের ফাঁদে পড়ে তামাক চাষে জড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারন হিসেবে জানাগেছে এসব টোব্যাকো কোম্পানি কতৃক কৃষকদের স্বল্প সুদে ঋন প্রদান ও তামাক বিক্রয় করে একত্রিতভাবে টাকা পাওয়া যায়।
এক সময় কৃষকরা যেখানে পরিবেশ সম্মত ভাবে মাটির উর্বর শক্তির সাথে মেচিং সোনালী ধান ও রবি শস্য সহ সবুজ ফসলাদী চাষ করতো , সেখানে এখন তারা সামান্য লোভে পড়ে তামাক চাষ অব্যাহত রেখেছে। সরকারী জমি যেমন খাস, বনবিভাগের জমি, ও নদীর পানির ৫০ হাত দুরত্বের ভিতরে পরিবেশ বিধ্বংসী তামাক চাষ না করার জন্য সম্পুর্ন নিষেধ থাকলেও তা কাজেই মানা হচ্ছেনা কোথাও, আর বনবিভাগের নীরবতায় তামাক সিদ্ধির কাজে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়ে বনভুমি উজাড় করে দেয়া হচ্ছে,কক্সবাজার উত্তর বিভাগের বাঘখালী রেন্জের বাঘখালী বিটের অধীনে কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের গোদার মুখ, গামার তলি, গোদামকাটা, সওদাগর পাড়া,ফুটের ঝিরি,লাল মইন্না, নুনাহলা,ধইল্লাছড়ি,মহলের ঘোনা,পাতা খলা,কলার জিরি, ক্যায়াজর বিল,লেবু ছড়ি, বাঘঘোনা,কচ্ছপিয়া বিট,জোয়ারিয়রিয়ানালা রেন্জে, ঈদগড় রেন্জের বিভিন্ন বিটও কক্সবাজার দক্ষিন বনবিভাগের রাজার কুল, ধোয়াপালং রেন্জের বিভিন্ন বিটের অধীনে বনাঞ্চলের অভ্যন্তরে বনবিভাগের হাাজার হাাজার একর জমিতে তামাক চাষ অব্যাহত রয়েছে।
তথানুসন্ধানে জানাগেছে মৌসুমের শুরুতে বাঘখালী বিটের অধীনে বিভিন্ন সময় লোক দেখানো তামাক চাষবিরোধী মাইকিং করা হলেও পরে তাদের ম্যানেজের মাধ্যেমে তামাক চাষ অব্যাহত থাকে ।
চলতি মৌসুমে মাইকিংতো দুরের কথা বনবিভাগকে ম্যানেজ করার কথা বলে প্রতি ৪০ শতক প্রতি ৫ শত টাকা করে স্হানীয় হেটম্যান আব্দুল কাদেরের নেতৃত্বে একটি চক্র বনাঞ্চলের জমির চাষীদের কাছ থেকে টাকা উঠাচ্ছে বলে জানাগেছে।
বনবিভাগের জমিতে তামাক চাষের ব্যাপারে জানতে চাইলে বাঘখালী রেন্জের নবাগত কমর্কর্তা সরওয়ার জাহান বলেন বনবিভাগের জমিতে তামাক চাষের তথ্য তিনি জানেনা, অথচ রেন্জ অফিস থেকে ২ কিঃমিঃ দুরত্বে গোদার মুখ নামক স্হানে বনবিভাগের শত শত একর জমিতে সরজমিনে তামাক রোপনের দৃশ্য অবলোকন করাযায়।
অপরদিকে প্রতি মৌসুমে চুল্লি তৈরি করে তামাক পাতা সিদ্ধির জন্য পুড়ানো হয় বনের তাজা কাঠ। এতে করে দেদারছে উজাড় হয় বনাঞ্চল,পাশাপাশি তামাক পুড়ানো দূষিত ধোয়ায় বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা কমে বৃদ্ধি পায় নাইট্রোজেনের পরিমান যার ফলে প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে পরিবেশের ভারসাম্য।
এছাড়াও তামাক পুড়ানো বিষক্রিয়ায় মানুষের সৃষ্টি হচ্ছে সর্দি, কাশি, এজমা আলসার ও ক্যান্সারসহ নানাবিদ দুরারোজ্ঞ ব্যাধি। তামাক চাষের সুবিধা সম্পর্কে জানতে চাইলে, কৃষক হামিদুল হক বলেন, আমি গত তিন বছর ধরে তামাক চাষ করে আসছি। একটি কোম্পানি থেকে ঋণ নিয়ে এ চাষ শুরু করি। সারা বছর ধরে তামাক চাষের টাকা দিয়ে ঋণ সুদ করলেও পরের বছর আবার ঋণ নিতে হয় এর জন্য। খরচ কোন মতেই পুষিয়ে উঠতে পারি না।
তামাক চাষ শুধুমাত্র খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি নয়, এই বিষবৃক্ষ চাষ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বিপনন সকল ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত করছে জনসাধারণকে। তামাক এমন একটি ফসল যা চাষের কারণে জমির উর্বরতা হ্রাস পায় এবং এই জমিতে একসময় কোন ফসল ফলানো যায় না। তামাকের কারণে ৩টি মৌসুমের ফসলের ক্ষতি হয়। কারণ জমি তৈরি, বীজ বপন, পরিচর্যা, পাতা তোলা, গোড়া তোলা ইত্যাদি কারণে তামাক চাষের সময়কাল অক্টোরব থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রায় ৮ মাস। চাষীদের বক্তব্য অনুসারে তামাক চাষ করলে অন্য কিছু করার সুযোগ পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু প্রতিবছর অর্থ ও নানা প্রলোভনের কারণে চাষীরা তামাক চাষে নিয়োজিত হয়ে পড়ে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে গিয়ে মহাজনদের ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে নানা ধরনের অমানবিক নির্যাতনের স্বীকার হতে হয় তামাক চাষীদের।
এমন ক্ষেত্রে ঘরবাড়ি সর্ব বিক্রি করে মহাজনদের ঋন পরিশোধ করতে গিয়ে দেওলীয়া হতে দেখে মিলেছে গ্রামান্তরের অনেক কৃষকদের।
জানতে চাইলে আরেক কৃষক গফুর মিয়া বলেন, আমি আগে তামাক চাষ করতাম,আমি আগে তামাক চাষ করতাম, কিন্তু তামাক চাষে তেমন সুবিধা পেতাম না আর জানতে পারি যে তামাক একটি বিষাক্ত উপাদান। তাই বেচে নিলাম সবজি এবং ভূট্টার চাষ। বর্তমান সরকার দেশজুড়ে তামাক চাষ বন্ধ ও তামাকের ভয়াবহতা সম্পর্কে গনসচেতনামুলক প্রচার করে আসছে, সেখানে রামু উপজেলা জুড়ে চলছে অব্যাহত ভাবে তামাক চাষ। সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার্থে কৃষকদের সবুজ ফসলাদী চাষে উদ্বুদ্ধ ও সহযোগীতা করে।
এতে করে সবুজ বনাঞ্চল রক্ষা পাবে, পাশাপাশি চরমভাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাবে লক্ষ লক্ষ মানুষ। সরেজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে দেখা মেলে নির্মমতার এক দৃষ্টান্ত, বাঁকখালী নদীর দুপাশে বিস্তৃত এলাকায় ছেয়ে গেছে তামাক চাষ।
বাংলাদেশে দারিদ্র ও অপুষ্টি একটি বড় সমস্যা এবং জনসংখ্যা অতিরিক্ত বৃদ্ধির কারণে জমির উপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। জনসংখ্যার অনুপাতে জমির পরিমাণ কম থাকায় খাদ্য ঘাটতি পুরণ করা কষ্টকর হয়ে পড়ছে। যেখানে সব আবাদী জমিতে খাদ্য উৎপাদন করা দরকার সেখানে তামাক কোম্পানিগুলোর প্রলুব্ধকর প্রচারণায় দরিদ্র অনেক কৃষক তামাক চাষে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। এ ধরণের অবস্থা দারিদ্রকে ত্বরান্বিত করছে, পুষ্টি ঘাটতি ও খাদ্য ঘাটতি বৃদ্ধি করছে। তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে একটি নীতিমালা জরুরি ভিত্তিতে প্রণয়ণ ও তা মাঠ পর্যায়ে বাস্হবায়ন অতি প্রয়োজন। পাশাপাশি ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০০৫ সংশোধনের মাধ্যমে আইনগতভাবে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে বিষয়টি নিশ্চিত করার দাবী উঠেছে
পাঠকের মতামত: